Skip to main content

সে রাতে পূর্নিমা আসেনি || লেখক : তারেক সাকিব || ঢাকা মেট্রো চ ||



সে রাতে পূর্নিমা আসেনি
-তারেক সাকিব


-ছোটভাইয়া কি করছো.!
-দেখছিস না কি করছি.!
-বই পড়ছো.! কি বই.?

বইটা বন্ধ করে ঘুরে আসরাফীর দিকে তাকালাম।

-কিছু বলতে চাইলে বলে ফেল।
- না মানে একটা প্রশ্ন ছিল। আচ্ছা বড় আপার জামাইকে তো আমরা দুলাভাই ডাকি, আমার বিয়ে হলে আমার জামাইকেও কি দুলাভাই ডাকবা.?
-বুঝেছি তোমার বিয়ের শখ হয়েছে। আচ্ছা দাড়া, কাকিমা কে ডেকে বলছি.!

কাকিমা কে ডাক দিতেই ও উঠে এসে আমার মুখ চেপে ধরলো।

-ধুর ধুর ধুর, আমি কখন বললাম যে আমার বিয়ের শখ হয়েছে.!
বলেই আমার চুল টেনে দিয়ে রুম থেকে পালালো। আসরাফী আমার চাচাতো বোন। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। বাবারা তিন ভাই বিয়ের পরেও আলাদা হয়নি। আমরা ভাইবোনেরা মিলে সাত জন। আসরাফী সবাইর ছোট। এবার উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে। রূপবতী, গুণবতী আর ডানপিটে, এই তিনটা গুণ যে একসাথে পাওয়া যায়, তা ওকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। গতবার দাদার মৃত্যুবার্ষিকীতে ওর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে চেয়ারম্যান সাহেব তো বলেই দিয়েছিলেন
-আসরাফীর মতো মেয়ে এই গ্রামে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সারা গ্রামের বাচ্চাদের অঘোষিত লিডার বলা যায় ওকে। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে বড় আপা বিয়ের পর চিটাগাং চলে গেছে আর আমি পড়ালেখার জন্য ঢাকায় থাকি। তাই বাকি সবাইর আমাদের জন্য একটু বেশিই ভালোবাসা। আর আসরাফীর কাছে তো সারা পৃথিবী একদিকে আর আমি আরেকদিকে। যত আবদার, খুনসুটি কিংবা উদ্ভট সব প্রশ্ন আমার কাছেই সব। এবার বেশ লম্বা ছুটিতে এসেছি বাড়িতে। তাই সবাইর থেকে ওর আন্দদটাই একটু বেশি। বাড়িতে আসার প্রথম কয়েকদিন বেশ ঘটা করে রান্নাবান্না হয় আমাদ জন্য। আজকে দুপুরের মেন্যুতে আছে,
১. ভুনাখিচুড়ি
২. গরুর রেজালা
৩. নিরামিষ
৪. ডিম ভুনা
৫. মুরগির রোস্ট
৬. ইলিশের পাতুড়ি
সবশেষে খাটি মহিষের দুধের ফিরনি। উদরপূর্তি করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আসরাফী এসে হাজির।

-যাক ভালো হলো তুই এসেছিস, মাথাটা একটু ম্যাসাজ করে দে তো.! একটা ঘুম দিবো ভাবছি।
-আসছে উনি ঘুমাতে.! ঘুমানো যাবে না এখন। বাজারে যাও।
-বাজারে.! এখন বাজারে কেন.?
-বারে.! সেই কবে তুমি এসেছো… এরপর আর কোন মুভিই দেখা হয়নি। আজকে যাও মুভি নিয়ে আসো। আমরা দুইজন সারারাত বসে বসে মুভি দেখবো।

কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। ওর মায়াবী এই মুখটা দেখলে মনে চায় পুরো পৃথিবীটা এনে হাজির করি ওর সামনে। কিন্তু আপাতত মুখ ভার করে বললাম,

-আমি এখন কোত্থাও যাচ্ছি না, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে আমার।
কথাটা বলেই মেকি হাই তোলা শুরু করলাম।
-তুমি যদি না যাও ছোটভাইয়া, আমি আর কথাই বলবো না তোমার সাথে।

আরেকটু ঘাঁটাতে চেয়েও মনের ইচ্ছাখানা দমন করলাম। ওর চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ সিরিয়াস। একবার ওর সাধের আমের মোরব্বা চুরি করে খেয়ে ফেলেছিলাম দেখে দুইদিন আমার সাথে কথা বলেনি। তারপর কত কাণ্ড করে সেবার রাগ ভাঙিয়েছিলাম.! সে কথা মনে পড়তেই ভদ্রছেলের মতো চুপচাপ বাজারে চলে গেলাম রতনের দোকানে ছবি ডাউনলোড করতে। ফেরার পথে সালামত চাচার সাথে দেখা।

-চাচা আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন.?
-এইতো বাবা আছি আল্লাহ্‌র রহমতে ভালো। তোমার খবর কি.?
-জি চাচা আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-তো বাবা শুনলাম এবার নাকি বেশ কিছুদিন থাকবা বাড়িতে, তাইলে আমার কুলছুমারে একটু অংক টংক দেখাইয়া দিও। মাইয়াডা আমার এক্কেবারে বেকুব কিসিমের। পড়ালেখায় এক্কেবারে জিরু। তুমি একটু দেখাইয়া দিলে যদি কিছু হয় আরকি।
-ঠিক আছে চাচা, আমি প্রতিদিন সকালে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসবো।
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।

চাচার কাছথেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম।
সন্ধ্যা হতেই আসরাফী এসে তাড়া দেওয়া শুরু করলো।

-ছোটভাইয়া জানো.! আমি এক বোল পপকর্ণ ভেজেছি। রাত পর্যন্ত কোন উঠাউঠি নেই। একেবারে দুইটা মুভিই শেষ করে তারপর উঠবো।
-সে কিরে.! তুই তো দেখি আজকে পপকর্ণ খাইয়েই আমাকে মেরে ফেলবি দেখছি।
-আরে ধুর.! একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।

দুই ভাইবোন মিলে বেশ আয়োজন করেই মুভি দেখা শুরু করলাম। একটু পর মেঝো ভাইয়া আর আব্বুও এসে যোগ দিল আমাদের সাথে। প্রথমটা শেষ হতেই আম্মু আর জেঠিমা এসে খাওয়ার জন্য ডেকে গেলো। ততক্ষণে পপকর্ণ খেয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ। তবুও অল্প করে খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পরে হঠাৎ করেই মনটা ভীষণ এক ভালো লাগায় ভরে উঠলো। আকাশে থালা সমান এক চাঁদ উঠেছে। এতোক্ষণ তা খেয়ালই করিনি। খাওয়া শেষ করে সবাই যার যার রুমে চলে গিয়েছে। আসরাফী আমার রুমে আসছিল, কিন্তু আমাকে দেখলো ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি।

-ছোটভাইয়া কোথায় যাচ্ছো.! মুভি দেখবে না.?
-আকাশে কত্ত সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছিস.? এতো সুন্দর চাঁদ কে একলা রেখে ঘরে বসে থাকাটা কি ঠিক.!
-আমিও আসি তোমার সাথে.?
-আচ্ছা আয়।

আমরা দুইজন হাটতে হাটতে পুকুরপাড়ে আসলাম। গ্রামে আমাদের পুকুরঘাটের একটা ডাক আছে। আমাদের ঘাট পুরোটা শ্বেত পাথর দিয়ে বাধাই করা। ঘাটের দুইপাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ সবসময় ছায়া দিয়ে রাখে। সকাল বিকাল দুইবেলা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে কৃষকরা এই ঘাটে এসে শুয়ে থাকে। আমি আর আসরাফী একেবারে শেষ সিঁড়িতে গিয়ে পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে বসলাম।

-আজকে চাঁদের হিসেবে কত তারিখ বলতে পারবি.!
-উঁহু।
-১৩ তারিখ। অর্থাৎ কাল পূর্ণিমা। ১৭ শতকের দিকে উপমহাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে পূর্ণিমারাতে বেশ কিছু রীতি পালন করতো হিন্দুরা।
-কি রকম রীতি.!
-যেমন, পূর্ণিমারাতে পুরুষরা সন্ধ্যার পর যার যার ঘরে ঢুকে যেতো, সারারাত আর বের হতো না। এমনকি তাদের টয়লেট ধরলেও ঘরেই কাজ সমাধা করতো। রাতের খাবারে খেতো শুধু মাছ আর ডিম দুধ। আকাশ যখন পুরো পরিষ্কার হয়ে যেতো, চাঁদ পুরোপুরি ফুটে উঠতো, তখন বিবাহিত মেয়েরা বের হতো। একেবারে উলঙ্গ অবস্থায়। তারপর দীঘির জলে সবাই একসাথে গোসল করে শরীর না মুছেই যার যার ঘরে চলে যেতো স্বামীর কাছে। তারপর সারারাত তারা মিলনে ব্যস্ত থাকতো। তারা বিশ্বাস করতো এই মিলনের ফলে যেই সন্তান জন্মাবে, সে দেবতা কৃষ্ণের মতো সৌভাগ্যবান আর রামের মতো শক্তিশালী হবে।
-আসলেই কি এমন হতো.!
-না।
-তারপরেও এই বিশ্বাস করতো.!
-হ্যা করতো। তবে ১৮ শতকে স্বামী বিবেকানন্দ এই কুসংস্কার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলে। তারপর আস্তে আস্তে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
-ইশশস, এখনো যদি এই কুসংস্কারটা থাকতো তাহলে কি হতো.!
-তোর মাথা হতো।

হঠাৎ করেই পিনপতন নীরবতা আমাদের চারপাশ গ্রাস করে নিলো।

-ছোটভাইয়া.! আমি তোমার হাসিটা চিনি। আজ সারাদিন তুমি যে হাসিটা দিয়েছো, এটা তোমার হাসি নয়। কি হয়েছে বলবে আমাকে.?
-“ও” চলে গেছে আমাকে ছেড়ে, একেবারে।
-“ও”.! কে.?
-ভার্সিটির ওরিয়েন্টেশনের দিন আমার পাশে এসে বসেছিল। তারপর আড়াই বছর, ৫ টা সেমিস্টার। কতগুলো সন্ধ্যা আমরা হাতে হাত ধরে কাটিয়ে দিয়েছি.! কখনো গুণেই দেখিনি। এই এক মাসে যতবার বৃষ্টি নেমেছে, আমি সবথেকে বেশি মিস করেছি ওর ঠোঁটের উষ্ণতা। এই আড়াই বছর, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আড়াই বছর। এতো এতো স্মৃতি.! তবুও কত কিছু বাকি রয়ে গেছে জীবনে। বেইলী রোডের অনেক ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে দ্বিতীয়বার টক চাওয়াটা বাকি রয়ে গেছে। কিংবা ধানমণ্ডির অনেক রিক্সাওয়ালা বাকি আছে, যাদের সাথে এখনো ভাড়া নিয়ে তর্ক করা হয়নি। মোহাম্মদপুরের অনেক চা দোকানদার তো আমাদের চিনেই না। এতো কিছু ফেলে রেখে ও চলে গেছে।
-কেন গেছে.? তুমি আটকালে না কেন.!
-আমার অনেক সময়ের দরকার ছিল, কিন্তু ওর আর ফ্যামিলির হাতে সময় ছিল না, তাই চলে গেছে।
-তুমি অন্তত মেঝো মা'কে তো জানাতে পারতে.!
-মাথার উপর বড় ভাইয়া মেঝো ভাইয়াকে রেখে কিভাবে আমি আগাই বলতো.!

একগুচ্ছ নীরবতা আবার আমাদের চারপাশটা দখল করে নিয়েছে। নীরবতা ভেঙে আসরাফী বলে উঠলো,

-অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাবা না.!
-এতো বড় একটা চাঁদকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাই বল.! তুই গিয়ে শুয়ে পর।
-আমিও থাকি আরেকটু.!

-চাঁদ টা না হয় আজ আমি নিলাম,
ঘুমটা দিলাম তোকে।
আমি বন্ধু ভালো আছি,
তুমিও থেকো সুখে।

ছন্দ ক'লাইন বলে আমি হো হো করে হেসে ফেললাম। প্রত্যুত্তরে আসরাফীও মুচকি হেসে উঠে চলে গেলো। এই একলা পুকুরঘাটে আমি বসে আছি, আর আমার মাথার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হাজার বছর ধরে বয়ে চলা এক চাঁদ।


Comments

Popular posts from this blog

মানসিক সমস্যায় নারী-পুরুষ | ঢাকা মেট্রো চ

মা ন সিক সমস্যায় না রী-পুরুষ লেখক: কে. এম. ধ্রুব আপনি যখন মেন্টাল স্যাটিসফ্যাকশনের অভাবে ভুগবেন তখন মনোবিজ্ঞানীর দারস্থা হবেন। লক্ষ্য করে দেখবেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সেন্টারে আপনার আশেপাশে যারা আছে তাদের অধিকাংশ নারী। বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বেই এসব সেন্টারে নারীরা সংখ্যাগুরু। তবে কি পুরুষেরা মেন্টাল স্যাটিসফ্যাকশনের অভাবে ভুগে না? ধরে নেয়া যাক নারীরা মানসিক সমস্যায় বেশি ভুগে আর পুরুষেরা কম। কিন্তু বিজ্ঞান কি বলে? পরিসংখ্যান কি বলে? বিগত দু বছরে পুরুষের আত্মহত্যার হার নারীদের চেয়ে বেশি প্রায় ৩.৫৪ শতাংশ। এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশ আমেরিকাতে ৬মিলিয়ন পুরুষ দুশ্চিন্তায় থাকেন। এখানেই শেষ নয় পুরুষের মাদকাসক্তির হার নারীর চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। মদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে যেখানে প্রতি বছর ২৬,০০০ নারী মৃত্যুবরণ করে, যেখানে প্রায় ৬২,০০০ পুরুষ এই কারণে মারা যায়! পুরুষের জন্য যে ব্যাপারটা অতি সাধারণ সেই পুরুষেরাই কেনো মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কম যান? মূলত ব্যক্তিত্ব বা তথাকথিত পৌরুষপূর্ণ ব্যক্তিত্বের জন্য তারা সমস্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। যদিও আমাদের জেনারেশনের আমরা বেশিরভাগ মানুষই...