Skip to main content

অপরূপা || লেখক : তারেক সাকিব || ঢাকা মেট্রো-চ ||





চোখের কোণায় কালো কাজলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে।-এহহহ! মিথ্যা বলেন কেন?-মিথ্যা না গো, তিনসত্যি।-আচ্ছা দাড়ান….
বেশ কয়েক মিনিট পর কয়েকটা ছবি পাঠালো ইনবক্সে অপরূপা। পুরো চোখের চারপাশ লেপ্টে ফেলেছে কাজল দিয়ে। তবুও খুব মায়াবী লাগছে ওকে। আসলেই কি ও এতো মায়াবী! নাকি আমিই…….
-এখন কেমন লাগছে বলুন-ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। হয়তো দুইজনই খুঁজে চলছি কথা। শুরুটা করলো অপরূপা’ই।
-দাদা!-হুম বলো।-আমার সাথে আপনার কখনো দেখা হয়েছে?-উহু, হয় নাই।-ফোনে কথা হয়েছে?-হ্যা, বেশ কিছুক্ষণ। -কি কথা হয়েছিল?-অনেক জরুরি কিছু না, আবার ফেলে দেওয়ার মতোও না।-আপনি আমাকে কতটা চিনেন?-খুব অল্পই। -তবুও কেন দাদা?-কী কেন??-সত্যিই বুঝতে পারছেন না?
ভাগ্য ভালো মেয়েটা সামনে নেই। না হলে লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশে যেতাম।
-আকাশে দেখেছো কত্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে?-হুম।-কিন্তু কালো কালো মেঘের আবরণ, অথচ চাঁদে কলংক লাগাতে পারেনি এতোটুকুও।-আপনি খুব সুন্দর কথা ঘুরাতে পারেন দেখছি!-না কথা ঘুরাইনি। তুমি বোকা, তাই বুঝতে পারোনি। আচ্ছা তোমাকে একটা ধাধা ধরি?-হুম বলেন।
‘চাইতে গেলে পাই না, দিতে গেলে লয় না’, বলতো কি হবে?-জানি না তো।-হুট করে জানি না বলে ফেলবা না। ভেবে বলো কি হবে।-আচ্ছা ভেবেই বলবো, এখন টাটা।
অফলাইনে চলে গেলো অপরূপা।
ওর সাথে আমার পরিচয় চার মাস হলো। ভার্চুয়াল জগত থেকে হুট করে মেয়েটা যে কখন হৃদয়ে জায়গা করে নিলো, টেরই পেলাম না। কিন্তু ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে। হয়তো অপেক্ষা করছে আমার কাছ থেকেই শুনার। শুনার পর হয়তো কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিবে। তারপর দুপ করে হারিয়ে যাবে আমার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। যাক! আপাতত এসব ভেবে কাজ নেই। আকাশে মেঘ জমছে। এমন আবহাওয়ায় এক কাপ চা না খাওয়া নিতান্তই বোকামি। তাই কিচেনের দিকে হাটা দিলাম চা বানাতে। কাছেই কোথাও বেজে চলছে,
“সে আমারে, আমার হতে দেয় না”।
==
শীত কেবল শুরু হয়েছে। এ সময় টায় বিকেল হলেই হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে। বাসা থেকে গরম কাপড় নিয়ে না এসে মনে হচ্ছে ভুলই করলাম। এক ঝাকড়া শীত কাধে নিয়ে আদাবর এসেছি। আজকে অপরূপার জন্মদিন। ও জানে না আজকে আমি আসবো। এখন পর্যন্ত ওকে উইশ ও করা হয়নি। পকেট থেকে ফোন বের করে ওকে কল করলাম।
-অপরূপা কি করছো? -আমি? কই তেমন কিছু না তো!-আমি আদাবর দশ নাম্বার রোডের মাথায় দাড়িয়ে আছি। তুমি কি পাঁচ মিনিটের জন্য আসতে পারবে?-আচ্ছা।
অপরূপা আসলো তেরো মিনিটের মাথায়। একেবারে ঘরোয়া সাজে, টি-শার্টের উপর দিয়ে শাল জড়িয়ে খোলা চুলে। ওর সাথে পরিচয় আজ নয় মাস হতে চলল, অথচ এই প্রথম আমাদের সামনা-সামনি দেখা। বুকের ভিতরটায় কেউ একজন ক্রমাগত হাতুড়ি মেরে যাচ্ছে। ও যত এগিয়ে আসছে, হাতুড়ির বাড়ি তত দ্রুতবেগে বাড়তে থাকছে। গলার ঠিক নিচের অংশটাও দলা পাকিয়ে গেছে। 
-কি ব্যাপার দাদা, হঠাৎই এলেন যে?-হ্যাপি বার্থডে। -থ্যাংক ইউ।-এই বইটা তোমার জন্য, বার্থডে গিফট। 
একটা বই এগিয়ে দিলাম ওর দিকে।
-দাদা আমি এটা নিতে পারবো না।-কেন? আগে পড়েছো দেখে?-না, আমি জানি এই বইয়ে কি আছে। এই বইয়ে ভিন্ন ১৯টা পেইজে ১৯টা চিরকুট আছে। প্রত্যেকটা চিরকুটে আমাকে আপনি প্রেম নিবেদন করেছেন। পাঁচ মাস আগেই আপনি এই দৃশ্যটার একটা গল্প লিখেছিলেন। তখন থেকেই জানতাম আপনি এমনটা করবেন। তাই তখনই আমি ঠিক করেছি এই বইটা আমি নিবো না।
ও এভাবে না করে দিবে, আশা করিনি। গলার নিচ টায় আটকে থাকা দলাটা উপরে উঠতে চাইছে। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম আমার চোখে পানি এসে পরেছে। অপরূপা বুঝতে পারলে ব্যাপারটা খুব হাস্যকর হয়ে যাবে। তাই কিছু না বলেই উল্টো দিকে ফিরে হাটা শুরু করলাম। কয়েক কদম এগুতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো ও।
-দাদা!-হুম বলো।-অনেকদিন ধরে আপনি কিছু লিখেন না। আজকে একটা গল্প লিখবেন? আমাকে নিয়ে!-আচ্ছা।-শেষটা সুন্দর করবেন তো? আপনি সবসময় দুঃখী দুঃখীভাবে শেষ করেন।-আচ্ছা।-বইটা দিবেন না আমাকে? 
ফিরে এসে ওর হাতে দিলাম বইটা। তারপর হুট করে ওর দুই হাত চেপে ধরে বললাম,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি অপরূপা। 
ও কিছু না বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো। ও যাওয়ার পরপরই মনে হলো বিরাট ভুল করে ফেলেছি। আমি চাইলে আরো সুন্দর করে ওকে কথাটা বলতে পারতাম।কিন্তু ওকে দেখার পর থেকেই সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। পশ্চিমা আকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চারদিক থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আমি হাটা শুরু করলাম মেইন রোডের দিকে।
==
-এই যে মাত্র বাইর হইলো পোলাডা, লগে একটা ছুডো মাইয়া! ওগোরে চিন্না রাখবি। ওরা রোজ শুক্কুরবারে আহে এইহানে জিয়ারত করতে।-জানি, গত সপ্তাহে এইবার কইছেন।
মুখে বিরক্তির ছাপ দেখা গেলো জুবায়েরের। গত এক যুগ ধরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাহারাদার হিসেবে আছেন করিম মিয়া। গত সপ্তাহে তার একজন সঙ্গী দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। জুবায়ের। এটাই ওর জীবনের প্রথম চাকরি।  করিম মিয়া তাই ওকে সব শিখাচ্ছেন হাতে ধরে। আর নিয়মিত যাতায়াত কারীদের ও চিনিয়ে দিচ্ছেন।
-কি কইছিলাম?
পানের পিক ফেলতে ফেলতে প্রশ্ন করে করিম মিয়া।
-জুয়ান পোলাডার বউ মারা গেছে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়া, শুক্কুরবারে। হেরপর তেয় পোলাডা রোজ শুক্কুরবারে আহে কবর জিয়ারত করতে।-হ হ সাব্বাশ ব্যাটা। তুই তো আস্তে আস্তে হগেলেরেই চিন্না ফালাইতাছোস। 
জুবায়ের বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। করিম মিয়া থামে না, তার কথার তুবড়ি ছুটছেই।
==
-বাবা কি রান্না করছো?-ছোট চিংড়ি দিয়ে লাউয়ের তরকারী।-ওয়াও বাবা! আজকে কিন্তু আমি অনেকগুলো ভাত খাবো….-আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বলো হোমওয়ার্ক কম্পলিট করেছো??-হ্যা বাবা।-আচ্ছা এবার লক্ষী মেয়ের মতো টিভি দেখতে থাকো, বাবার রান্না শেষ হলেই বাবা ডাকবো। -অকে বাবা।
শতরুপার বয়স এবার আটে পড়লো। মেয়েটা কি ওর মায়ের মতোই হয়েছে? অপরূপাও কি এই বয়সে এমন চঞ্চল ছিল? ওর নানু তা-ই বলে। লাউয়ের তরকারি পেলে মেয়েটা খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। অপরূপাও এমনই ছিল। বৃষ্টি হলে শতরুপাকে তো ঘরেই আটকে রাখা দায় হয়ে যায়। ওর মা-ও বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসতো। আমার বাবা বলতেন,
“পৃথিবীতে শূণ্যস্থান বলে কিছু নেই। সবকিছুই কোন না কোনভাবে পূর্ণতা পায়-ই।”
অপরূপার ফেলে যাওয়া শূণ্যতায় পুরোমাত্রায় পূর্ণতা এনে দিয়েছে শতরুপা। 
অনেকদিন লেখালেখি করা হয় না। আজ দুটো লাইন মাথায় এসেছে। না লিখতে বসলে আবার হারিয়ে যেতে পারে সারাজীবনের জন্য। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, তিন নম্বর লাইনটা আর আসছে না জীবনে। অনেকগুলো পাতা বাকেটে ফেলা সত্ত্বেও আসলো না তিন নম্বর লাইনটা। বাধ্য হয়ে বিছানায় গেলাম। শতরুপা এখনো ঘুমায়নি। পাশে শুতেই শতরুপার আব্দার, 
-বাবা একটা গল্প শুনাও না!-কী গল্প শুনবে মা?-ওই যে, তুমি কিভাবে আমার আম্মুকে প্রপোজ করলে, সেই গল্পটা বলো না।-ওইটা তো পুরনো গল্প। অনেকবারই শুনেছো তুমি।-তবুও বলো না আরেকবার!-আজকে না, অন্যদিন বলবো। এখন ঘুমাও, কাল সকালে উঠতে হবে তো।-আচ্ছা, বাবা আরেকটা প্রশ্ন করি?-হুম বলো।-আম্মু কি ওই ধাধাটার উত্তর দিয়েছিলো?-হ্যা।-কি উত্তর? -ভালোবাসা। কারণ চাইলেই ভালোবাসা পাওয়া যায় না, আবার অনেকে সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়েও গ্রহণ করে না।
কথা শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝিই নি। এই একটা স্বভাব মেয়েটা আমার পেয়েছে। হুট করেই ঘুমিয়ে যাওয়া। 
পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে পরেছে। অথচ আমার চোখে ঘুম নেই। আজকাল ঘুম আসতে চায় না আর। আকাশে মেঘ জমছে। এমন আবহাওয়ায় এক কাপ চা না খাওয়া নিতান্তই বোকামি। তাই কিচেনের দিকে হাটা দিলাম চা বানাতে। কাছেই কোথাও আজও বেজে চলছে,
“সে আমারে, আমার হতে দেয় না”।

Comments

Popular posts from this blog

মানসিক সমস্যায় নারী-পুরুষ | ঢাকা মেট্রো চ

মা ন সিক সমস্যায় না রী-পুরুষ লেখক: কে. এম. ধ্রুব আপনি যখন মেন্টাল স্যাটিসফ্যাকশনের অভাবে ভুগবেন তখন মনোবিজ্ঞানীর দারস্থা হবেন। লক্ষ্য করে দেখবেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সেন্টারে আপনার আশেপাশে যারা আছে তাদের অধিকাংশ নারী। বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বেই এসব সেন্টারে নারীরা সংখ্যাগুরু। তবে কি পুরুষেরা মেন্টাল স্যাটিসফ্যাকশনের অভাবে ভুগে না? ধরে নেয়া যাক নারীরা মানসিক সমস্যায় বেশি ভুগে আর পুরুষেরা কম। কিন্তু বিজ্ঞান কি বলে? পরিসংখ্যান কি বলে? বিগত দু বছরে পুরুষের আত্মহত্যার হার নারীদের চেয়ে বেশি প্রায় ৩.৫৪ শতাংশ। এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশ আমেরিকাতে ৬মিলিয়ন পুরুষ দুশ্চিন্তায় থাকেন। এখানেই শেষ নয় পুরুষের মাদকাসক্তির হার নারীর চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। মদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে যেখানে প্রতি বছর ২৬,০০০ নারী মৃত্যুবরণ করে, যেখানে প্রায় ৬২,০০০ পুরুষ এই কারণে মারা যায়! পুরুষের জন্য যে ব্যাপারটা অতি সাধারণ সেই পুরুষেরাই কেনো মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কম যান? মূলত ব্যক্তিত্ব বা তথাকথিত পৌরুষপূর্ণ ব্যক্তিত্বের জন্য তারা সমস্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। যদিও আমাদের জেনারেশনের আমরা বেশিরভাগ মানুষই...